নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও উত্তম কৃষি চর্চা
মোঃ বেনজীর আলম
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি কৃষি খাত। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্থিরমূল্যের ভিত্তিতে ১২.৫২ শতাংশ (২০১৫-১৬ বছরকে ভিত্তি ধরে, বিবিএস-ডিসেম্বর, ২০২১)। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও দিকনির্দেশনায় এবং বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য বিকশিত পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক, বর্তমান সরকারের সফল কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাকের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। এরই অংশ হিসেবে রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি, কয়েকটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০সহ বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। কৃষি ক্ষেত্রে সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে খোরপোশের কৃষি এখন বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে দেশে কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট খাতে প্রভূত উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সম্প্রসারিত হয়েছে।
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অঞ্চল বিশেষে এক ও দুই ফসলি জমিকে প্রায় তিন বা চার ফসলি জমিতে পরিণত করা হয়েছে। দেশে বর্তমানে ফসলের নিবিড়তা প্রায় ২১৬ শতাংশ। বিশ্বে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন অন্যান্য দেশের নিকট অনুকরণীয়। জনসংখ্যা-জমি অনুপাতে ফসল উৎপাদনের হার বিস্ময়কর। বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। নিবিড় সবজি চাষের মাধ্যমে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৯৭.১৮ লক্ষ টন শাকসবজি (আলু ছাড়া) উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। শীতকালীন বা গ্রীষ্মকালীন নয়, প্রায় সারা বছরই এখন সব ধরনের সবজি পাওয়া যায়। বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় হলেও এ খাতে এখনও রয়েছে বিভিন্নমুখী সমস্যা ও সম্ভাবনা। আধুনিক বিপণন অসুবিধাকে ব্যবহার করে মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের নিকট থেকে কম দামে কিনে নিচ্ছেন কৃষিপণ্য। দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশেও চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি পণ্য (প্রক্রিয়াজাতসহ) এখন বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নিরাপদ সবজি আবাদের চর্চা বাড়ছে। বর্তমান সরকারের নীতিগত সমর্থন ও প্রত্যক্ষ পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে, পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও নিশ্চিতের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ ফল ও সবজির উৎপাদনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কৃষি খাতে বায়োটেকনোলজি, পার্চিং, ফেরোমন ফাঁদ, আইপিএম, আইসিএম, উত্তম কৃষি চর্চা (GAP) ইত্যাদি ব্যবহার করে যথাসম্ভব নিরাপদ পণ্য সহজলভ্য করার প্রচেষ্টা হচ্ছে। উত্তম কৃষি পদ্ধতি হলো সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রম, যা অনুসরণে নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত কৃষিজাত পণ্য সহজলভ্য এবং পরিবেশ, অর্থনীতি ও সামাজিক সুরক্ষা সুসংহত হয়। এটি একগুচ্ছ নীতি, বিধি ও প্রযুক্তিগত সুপারিশমালা যা মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, পণ্যের মান উন্নয়ন ও কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য। সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবহনের বিভিন্ন স্তরে প্রয়োগ করা হয়।
বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্যের বাজার সৃষ্টি হয়েছে এবং খাদ্যসামগ্রী নিয়মিতভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আমদানি ও রপ্তানি হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধানে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেশে দেশে খাদ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। কৃষি উৎপাদনে নিরাপদ খাদ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ হলো প্রয়োগকৃত রাসায়নিকের অবশিষ্টাংশ, দূষণকারী বস্তুর উপস্থিতি, পোকামাকড়, রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব, বাহ্যিক সংক্রামক ইত্যাদি। এ ছাড়া খাদ্যে অন্যান্য বস্তু যথা- ভারী ধাতব বস্তু বা বিষাক্ত দ্রব্যের উপস্থিতি বিষয়ক বিপত্তি (Hazard) বা ঝুঁকি (Risk) খাদ্য শৃঙ্খলের যে কোনো পর্যায়ে ঘটতে পারে, তাই উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের প্রত্যেক স্তরেই নিরাপদ খাদ্য সংক্রান্ত সমস্যা প্রতিরোধ বা দূরীভূত করা প্রয়োজন। খাদ্য শৃঙ্খলের সকল স্তরে সুনির্দিষ্ট অনুশীলনসমূহ সঠিকভাবে অনুসরণ করাই হচ্ছে উত্তম কৃষি চর্চার মূলভিত্তি। উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে খাদ্য শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরে প্রত্যেক কর্মীকে তার নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয়ে দায়িত্বশীল থাকা আবশ্যক। উৎপাদনকারীকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে উৎপাদিত পণ্যসমূহ খাদ্য হিসেবে ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ।
উত্তম কৃষি চর্চায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা ২০২০ অনুমোদন ও প্রকাশ করেছে। এই নীতিমালার আলোকে ‘বাংলাদেশ GAP’ বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থায় কমিটি গঠনের পর সেখানে কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশGAP বাস্তবায়নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সনদপত্র প্রদানকারী সংস্থা (Certification Body বাCB) হিসেবে দায়িত্বপালন করবে। এই দপ্তরে ইতোমধ্যে CB কাঠামো গঠিত হয়েছে এবং তারা কাজ শুরু করেছে। যে সব এলাকা থেকে শাকসবজি ও ফলমূল রপ্তানির সম্ভাবনা বেশি সেসব এলাকাকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আশা করা যায় বাংলাদেশে GAP বাস্তবায়িত হলে কৃষি পণ্যের রপ্তানি অনেক বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশের কৃষি কৃষক পর্যায়সহ ব্যবসায়িক পর্যায়েও লাভজনক হবে।
বাংলাদেশ এখন টেকসই খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ভিশন ২০২১, দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ ও ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০ সরকারের মহৎ পরিকল্পনা শুধু নয়, এটি অর্থনৈতিক মুক্তি চ্যালেঞ্জের ভিশন। এগুলো বাস্তবায়ন হলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তব রূপ লাভ করবে। তবে বাংলাদেশের মানুষের মননে ও স্বাস্থ্যে আরও উন্নত হতে হবে। এর জন্য নিয়মিত ও পরিমিত সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় শাকসবজি ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন করে টেকসই খাদ্য ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সরকারের গৃহীত সকল পদক্ষেপকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিতে বদ্ধ পরিকর।
লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ফোন : ৫৫০২৮৩৬৯। ই-মেইল : dg@dae.gov.bd